We Love Muhammad (s)

We Love Muhammad (S)

লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২, বিকেল ০৪:৪৮

image

আমার পাঁচ বছর বয়সী পুত্র কিছুদিন যাবত নিজ থেকেই চলতে ফিরতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। ওর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম আল্লাহর সম্পর্কে ওর ধারণা এখন যথেষ্ট স্বচ্ছ। এই ব্যাপারে সন্তুষ্ট হবার পর ওকে শেখালাম, ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। এখন চলছে মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে জানার পর্ব। তিনি কে ছিলেন, দেখতে কেমন ছিলেন, মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, কিভাবে চলতেন, কি খেতে ভালবাসতেন, মানুষের সাথে কেমন ব্যাবহার করতেন, আল্লাহর সাথে তাঁর সম্পর্ক কেমন ছিল, আমরা তাঁর কাছ থেকে কি শিখব ইত্যাদি। ঠিক এ’সময় এক ইহুদীর বানানো ছবি নিয়ে পৃথিবীব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। তখন আমার পুত্রকন্যার পাশাপাশি আমার ছাত্রছাত্রীরাও জানতে চায় রাসূ্ল (সা) কে ছিলেন, কেমন ছিলেন, তাঁর শিক্ষা কি, তাঁর প্রতি আমাদের অনুভূতি কেমন হওয়া উচিত – ক্ষুদে অনুসন্ধিৎসুদের প্রশ্নের শেষ নেই। 

তাদের তাই বলি যা আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়। এ সত্ত্বেও যদি তারা বিমুখ হয়ে থাকে, তবে বলে দাও, আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ব্যতীত আর কারো বন্দেগী নেই। আমি তাঁরই ভরসা করি এবং তিনিই মহান আরশের অধিপতি’ (সুরা তাওবাঃ আয়াত ১২৮-১২৯)। প্রথমত, তিনি আমাদের মতই প্রয়োজন এবং অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, সুতরাং তিনি আমাদের সুবিধা অসুবিধা বুঝতেন, এজন্যই তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশসমূহ আগে নিজে পালন করে নিশ্চিত করে নেন এগুলো আমাদের পক্ষে পালন করা কঠিন বা অসম্ভব নয়, কোন কাজ কঠিন মনে হলে আল্লাহকে অনুরোধ করে কমিয়ে নেন (যেমন নামায পঞ্চাশ ওয়াক্তের পরিবর্তে পাঁচ ওয়াক্ত করে নেয়া- বুখারী ৩৪৫), খুঁটিনাটি থেকে বৃহৎ যেমন চুল আঁচড়ানো থেকে হাজ্জ্বের মত প্রতিটি কাজ নিজের উদাহরণ দিয়ে শিখিয়ে দেন আমরা কিভাবে করব। 

তিনি মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালোবাসতেন, তবে স্বাভাবিকভাবেই বাবামা যেমন অনুগত সন্তানকে কিঞ্চিত বেশি ভালবাসে তেমনি যারা আল্লাহর দ্বীনের জন্য সর্বস্ব উজার করে দিয়েছিলেন তাঁদের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ টান। তাঁর আচরনে এই পার্থক্য ধরা পড়তনা কেননা মনে মনে তিনি সবারই মঙ্গল চাইতেন, সবার সাথে উত্তম ব্যাবহার করতেন, সবাইকে সত্য জানানোর চেষ্টা করতেন। এমনকি তাদের মঙ্গলকামনায় তিনি মাঝে মাঝে এতটাই অধীর হয়ে পড়তেন যে আল্লাহ রাসূল (সা)কে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘যদি তারা এই বিষয়বস্তুর (কুর’আনের) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে, তবে তাদের পশ্চাতে সম্ভবতঃ আপনি পরিতাপ করতে করতে নিজের প্রাণ নিপাত করবেন’ (সুরা কাহফঃ আয়াত ৬)। একজন বাবা বা মা যদি দেখেন তাঁদের আদরের সন্তানটি না বুঝে আগুনে হাত দিতে যাচ্ছে তাহলে তাঁরা সর্বশক্তি দিয়ে তাকে বাঁধা দেবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে রাসূল (সা) যিনি মানুষকে এতটাই ভালোবাসতেন যে নিজে অভুক্ত থেকে অপরকে খাওয়াতেন, নিজের একটিমাত্র পোশাক থাকলেও বস্ত্রহীনকে কাপড় দিতেন, নিজের ঘরে খাবার না থাকলেও একটি পয়সা নিজের জন্য সঞ্চয় করে রাখতেন না- তিনি মানুষকে মহানন্দে দোজখের জ্বালানী হবার পথে চলতে দেখলে পাগলপাড়া হয়ে তাদের রক্ষা করতে চাইবেন এটাই কি স্বাভাবিক নয়? কিন্তু আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন অধিকাংশ মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ। তাই তারা তাঁর এই কষ্টের প্রতিদান দিয়েছে তাঁকে অপমান করে, শারিরীক এবং মানসিক কষ্ট দিয়ে, রক্তাক্ত করে, হত্যার চেষ্টা করে। রাসূল (সা) তবু আমাদের ভালই বেসে গেছেন। রাতের পর রাত নামাজে দাঁড়িয়ে তিনি কেঁদেছেন তাঁর উম্মতের মুক্তির জন্য। অথচ তাঁর আগেপরের সমস্ত গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন! 

এর পরে যারা তাঁর আহ্বানে সাড়া না দেয় বা তাঁকে অপদস্থ করার চেষ্টা করে তাদের সাথে বোঝাপড়া করবেন স্বয়ং আল্লাহ, যেমন তিনি করেছেন পূর্ববর্তী সকল নবী রাসূলের কাওমের সাথে- নূহ (আ), হুদ (আ), সালেহ (আ) কিংবা লূত (আ)। এ প্রসঙ্গে সুরা লাহাবের কথা বলা যায়। এই সুরাটি আমি কখনোই পড়তে পারিনা, আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। এখানে আবুলাহাবের শাস্তির কথা বলা হয়েছে যে রাসূল (সা)কে শারিরীকভাবে কষ্ট দিয়েছিল এবং তার স্ত্রীর শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে যে রাসূল (সা)কে কথা দিয়ে কষ্ট দিত। কিন্তু এগুলো তো শুধুই উদাহরণ। একই প্রকার শাস্তি কি তাদের জন্যও আসবেনা যারা পরবর্তীতে একই ধরণের কাজ করবে? 

আমার পুত্রকন্যাদের শুধাই- যে মানুষটি আমাদের এতটা ভালবেসেছেন যে নিজের আরাম আয়েশ, মানসম্মান, দেশ জাতি, অর্থবিত্ত, পরিবার পরিজন সবকিছুর বিনিময়ে চেয়েছেন আমাদের সত্যপথের সন্ধান দিতে; আমাদের চিন্তায় অস্থির হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বারবার, সারারাত জেগে আমাদের পাপের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন; সমস্ত নির্যাতন সহ্য করে আমাদের জন্য অশ্রু, ঘাম আর রক্ত ঝরিয়েছেন অঝোরে- সেই রাসূল (সা)এর প্রতি আমাদের ভালবাসা কি বাবামার প্রতি ভালবাসার উর্ধ্বে হওয়া উচিত নয়? দারিদ্র এবং ক্লেশের কষাঘাত সত্ত্বেও যেকোন মূহূর্তে যেকোন স্থানে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, সর্বাপেক্ষা স্মার্ট, ভদ্রতম এবং সুন্দরতম ব্যাবহারকারী ব্যাক্তি। তাঁর এই আদর্শ তাঁর শত্রুদের বন্ধুতে রূপান্তরিত করত, বিপথগামীকে পথে আনত, আবু লাহাব এবং তার স্ত্রীর মত অভিশপ্ত দম্পতির কন্যাকে সাহাবী বানাত [আসহাবে রাসূল (সা)- ৬ষ্ঠ খন্ড]। 

আজ আমরা যদি বলি তার প্রতি অমুসলিমদের আচরনে আমরা ক্ষিপ্ত তবে প্রথমেই প্রমাণ করার ব্যাপার আসবে আমরা, তাঁর অনুসারীরা, তাঁর সম্মান রক্ষা করছি কিনা। যেকোন ব্যাক্তির প্রতি ভালবাসার সর্বোত্তম প্রকাশ হোল তাঁকে অনুসরন করা। রাসূল (সা) এর ব্যাপারে তো বলাই হয়েছে তিনি আমাদের জন্য ‘উসওয়াতুন হাসানা’ বা সর্বোত্তম আদর্শ’। সেক্ষেত্রে আমরা যদি তাঁর আদর্শ অনুসরন করার পরিবর্তে শাহরুখ খান কিংবা অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করি তাতে কি রাসূলুল্লাহর (সা) অপমান হয়না? আমরা যদি তাঁর নাম শুনেও ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ বলতে কষ্টবোধ করি তাতে কি তাঁর অপমান হয়না? আমরা যদি প্রতিকুল পরিস্থিতিতে তাঁর আদর্শ অনুসরন করার পরিবর্তে নিজের খেয়াল খুশির অনুসরন করে ইসলামের ব্যাপারে অপবাদ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেই তাতে কি রাসূল (সা)এর অপমান হয়না? নিজেরা রাসূল (সা)কে পদে পদে অপমান করে আমরা কিভাবে তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নেব? 

তাহলে কি আমরা প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকব? না, কিন্তু আমরা ভাংচুর করে, অগ্নিসংযোগ করে, অশালীন ভাষায় কিংবা একের পাপের বিনিময়ে অপরকে হত্যা করে প্রতিবাদ করবনা। আমরা প্রতিবাদ করব রাসূল (সা)এর প্রদর্শিত পথে- শান্তিপূর্ণভাবে, সিভিলাইজড পদ্ধতিতে। আমরা প্রতিবাদ করব রাসূল (সা)এর আদর্শ নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে, তাঁর আদর্শকে সবার মাঝে উচ্চকিত করে, এই আদর্শ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে। 

গত পনেরোই সেপ্টেম্বর ক্যাল্গেরির মুসলিমদের একাংশ ক্যাল্গেরী মিউনিসিপাল বিল্ডিংয়ের সামনে প্রতিবাদ সভা করে। ডাউনটাউনের ব্যাস্ততম সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে শত শত মুসলিম জানায় আমরা এদেশের জনশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ; মুসলিমদের প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আচরনে আমরা ক্ষুব্ধ এবং আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে প্রতিবাদ আশা করি; শত শত অমুসলিম পথচারীদের মাঝে কুর’আন, রাসূল (সা)এর জীবনী এবং ইসলাম সম্পর্কে বই বিলি করা হয়; লিবিয়াতে ইউ এস অ্যাম্বাসেডরের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়; ঘৃণার পরিবর্তে ভালবাসার বাণী শোনানো হয়; একঘণ্টার সমাবেশ শেষে সবাই ক্যাল্গেরী মিউনিসিপাল বিল্ডিংয়ের সামনে একত্রে নামায আদায় করে। নামাজের পর অনেক অমুসলিম উপস্থিত লোকজনের কাছে জানতে চায় ওজু সম্পর্কে, নামায সম্পর্কে। ঝামেলা করার মত কিছু লোক যে ছিলোনা তা নয়, কিন্তু সমাবেশকারীদের আচরন ছিল অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত যেমন রাসূল (সা) শিখিয়েছেন। যারাই ঝামেলা করতে আসে তাদের ব্যাপারে পুলিশকে জানানো হয়, তারা ঝামেলাকারীদের সাথে কথা বলে তাদের স্থানত্যাগ করার নির্দেশ দেয় এবং কয়েকজনকে গাড়িতে তুলে পুলিশ স্টেশনে চালান করে দেয়। সবচেয়ে আদর লাগে একটি ছোট্ট শিশুকে যে বুকে প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে ঘুরছিল, ‘I love Muhammad (S), My name is Muhammad’. ছেলেটির বয়স বড়জোর সাড়ে তিন চার হবে, কিন্তু সেদিন উপস্থিত কোন শিশুই সেদিনের শ্লোগান ভুলবেনা ‘We love Muhammad (S), We hate hate’. তারা মনে রাখবে রাসূল (সা) পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এসেছিলেন, হিংসার জবাব বিদ্বেষ দিয়ে দেয়ার জন্য নয়। তারা জানবে আমরা রাসূল (সা) এর অনুসারী এবং আমাদের দায়িত্ব তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তাঁকে সম্মানিত করা। 

আল্লাহ রাসূল (সা)কে ওয়াদা করেছেন, ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি’ (সুরা ইনশিরাহঃ আয়াত ৪)। সুতরাং, যে যতই চেষ্টা করুক না কেন কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিবার আজানে তাঁর নাম সম্মানের সাথে উচ্চারিত হতে থাকবে, কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তাঁকে নিজের পিতামাতার চেয়ে বেশি ভালবাসবে, কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে সালাম পৌঁছতে থাকবে- দু’একটা মশা সামান্য ওড়াওড়ি করবে কিন্তু মশার জীবনের দৈর্ঘ্য কয়েকটি দিন মাত্র- এ’ নিয়ে এত অস্থির হবার কিছু নেই। কারণ আল্লাহর ওয়াদা সত্য, ‘নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’ (সুরা ইনশিরাহঃ আয়াত ৫-৬)। সেই স্বস্তি সেদিন আসবে যেদিন আমরা কেবল মুখে না বলে কাজে প্রমাণ করতে পারব আমরা রসুল (সা)কে কতটা ভালবাসি। 

ক্যাল্গেরী মিউনিসিপাল বিল্ডিংয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ

About আলোর কাফেলার সঙ্গী

আমি একজন মুবাল্লিগ ... আল্লাহ আমাকে কবুল করুন. আমিন

Posted on এপ্রিল 14, 2016, in রাসূলুল্লাহ সাঃ এর আদর্শ and tagged , . Bookmark the permalink. এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান