শুষ্ক নিয়মের বেড়াজালে : কিছু অর্থহীন সামাজিক রীতি

শুষ্ক নিয়মের বেড়াজালে : কিছু অর্থহীন
সামাজিক রীতি

image

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ বইয়ে অনেক পড়েছি
সেকথা। আর জীবন থেকেও দেখেছি আমরা
সবাই। সমাজটা মানুষ দিয়েই তৈরি। তবু এই সমাজের “হয়”
আর “নয়”গুলো কেমন যেন মানুষেরও
নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানুষের সমাজে মানুষের
দ্বারা তৈরি নিয়ম কানুনগুলো অনেকসময় মানুষেরই
গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসে। যেমন কিনা
মেয়ের বিয়ে দেয়ার সময়ের “হয়-নয়” গুলো।
আবার ঈদ- অনুষ্ঠান ইত্যাদির “না করলে তো চলে
না”গুলো! আর কিছু কিছু সৌজন্য আছে যা এককালে
অনেক মমতার থেকে সৃষ্টি হলেও এখন অনেক
ক্ষেত্রেই শুষ্ক নিয়মে পরিণত হয়েছে।
এগুলো নিয়ে কেউ তেমন একটা ভাবে না কারণ
মেয়ের বিয়ে দেয়ার মত শিরদাঁড়া ভাঙ্গা চাপ এগুলো
সৃষ্টি করে না! আবার, অনেকের ক্ষেত্রে,
করেও!
১। মানুষের বাসায় গেলেই কিছু একটা নিয়ে
যেতেই হবে-
সারাজীবন দেখেছি মানুষের বাসায় দাওয়াতে যাওয়ার
সময় কিছু না কিছু নিয়ে যেতে হয়। কোনদিন
সেটাকে বোঝা মনে হয়নি। তারপরও একবার হঠাতই
টের পেলাম, অনেকেই আগে আমাদের বাসায়
আসতেন, এখন আর আসেন না! আর তার কিছুদিন পর
আমার বাবা মা কে আলোচনা করতে শুনলাম যে
“এসব আসলেই বন্ধ করা উচিৎ।” কিসের কথা
বলছেন? না, মানুষের বাসায় গেলেই কিছু একটা
নিয়ে যেতেই হবে, এই নিয়মের কথা। ছোট
ছিলাম, খুব লজ্জা লাগত এভাবে কারুর বাসায় যেতে!
সবাই হয়ত হাসতই মনে মনে, যখন আমার বাবা বুঝিয়ে
বলতেন যে কেন আমরা খালি হাতে গিয়েছি, আর
আমরা চাই অন্যেরাও খালি হাতে আসুক! কিন্তু, তার
অল্প কদিন পর, সেই হঠাৎ আমাদের বাসায় আসা বন্ধ
করা মানুষগুলো আবার আসা শুরু করলেন! অবস্থা
পড়ে যাওয়াতে তাঁরা আর সামাজিকতা বজায় রাখতে
পারছিলেন না। যখন দেখেছেন সেই নিয়ম পালনটা
আমরাই ছেড়ে দিয়েছি, তখন তাঁরা নিশ্চিন্তে আসা
যাওয়া শুরু করলেন!
ব্যাপারটা কতখানি পীড়াদায়ক হতে পারে আমি
বুঝেছিলাম প্রথমবার সৌদি আরবে এসে! প্রায়
প্রতিদিনই দাওয়াত! সবার বাসায় হাতে করে কিছু নিয়ে
যাওয়া তো তখনকার অবস্থায় সম্ভব ছিল না! শুনলাম
ওখানে নাকি অলিখিত নিয়ম আছে– স্টুডেন্টরা কারুর
বাসার দাওয়াতে যাওয়ার সময় হাতে করে কিছু নিবে না!
ফ্যাকাল্টি যারা ছিলেন, সবাই একসময় কষ্ট করে
স্টুডেন্ট লাইফ পার করেছেন। তাঁরা তাই বুঝতেন।
তখন বুঝেছিলাম ব্যাপারটা কেবল আমাদের না, প্রতিটা
স্টুডেন্টের পরিবারের জন্যই অনেক সবস্তির
ছিল। হ্যাঁ, তারপরও আমরা নিয়ে যেতাম কিছু কিছু
সময়ে, কিন্তু কোনও দায় বদ্ধতা ছিল না! আর মিষ্টিই
নিতে হবে এমন কোনও ব্যাপারও ছিল না– কারুর
জন্য ভালবাসা দেখানোর জন্য এক বয়াম আচার, অথবা
শুঁটকি ভর্তাই যথেষ্ট ছিল!!
ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছি। রাস্তা পার হওয়ার সময়
আমার বাবার একজন বন্ধুর স্ত্রীর সাথে দেখা! তিনি
ফিরছিলেন স্কুলে পড়িয়ে। আমি বললাম, “বাসায়
চলুন!” এই চাচী আমাকে অনেক স্নেহ করতেন।
আমার অনুরোধ উপেক্ষা করাটা তাঁর জন্য মুশকিল।
তবুও বল্লেন,”আজকে না যাই?” আমি কিছুতেই যখন
তাঁকে ছাড়ছি না, তখন বললেন, “তোর ছোট
ভাতিজাটা হয়েছে, আমি তাঁকে দেখতেও আসিনি,
এখন খালি হাতে যাবো…?!” আমিও যেন আকাশ
থেকে পড়লাম! সামাজিক ব্যবধান বুঝি এভাবেই তৈরি
হয়! একসময় এই চাচীই কত এসেছেন আমাদের
বাসায়, রান্নাঘরে পা ছড়িয়ে বসে কত গল্প
করেছেন আমার মায়ের সাথে। আমি তাঁদের
আর্থিক সমস্যার কথা জানি, আজকে তাঁর অস্বস্তি
লাগছে খালি হাতে নতুন বাচ্চা দেখতে, তাই তিনি বাসায়
আসতে সঙ্কোচ বোধ করছেন!! আমি জোর
করে সেদিন তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মা
তাঁকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “যখন মনে চায়
আসবে, কিছু আনতে হবে তোমার আমার বাসায়??
আমিও কি খালি হাতে যাই না??” সেদিন মনে
হয়েছিলো ভাগ্যিস আমরাও ওসব “করতে হবে”
ব্যাপারগুলো জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছি, তাই
অমন করে একজনকে আশ্বস্ত করতে পারছি!
২। খালি বাটি ফেরত দেয়া
কারুর বাসা থেকে কিছু খাবার আসলে বাটিটা আমরা
ভরে ফেরত দেই। একজন ছিলেন, সবাইকে
অনুরোধ করতেন এমনটা না করার। কারণ তিনি খুব
ডিপ্রেশানে ভোগেন। তাঁর অসুখটা বাইরে
থেকে মানুষ বুঝতে পারে না। কিন্তু তাঁর কিছু
করতে খুব কষ্ট হয়। হ্যাঁ, তিনিও করেন, যখন সুবিধা,
তখন করেন। কিন্তু মানুষের বাটি ভরে ফেরত
দিতেই হবে, এই বোঝা বহন করা তাঁর মানসিক
অবস্থায় সম্ভব না! আমিও তখন ভেবেছি, সতিই
তো– শুধু ডিপ্রেশান কেন, অনেক কারণেই
কেউ না পারতে পারেন। এসব যখন নিয়ম হয়ে যায়,
তখন তো মুশকিল! ঠিক কতখানি মুশকিল তা আমি
বুঝেছিলাম একজনের কথায়। তিনি বলছিলেন, এসব
ফ্যামিলি থেকে আসতে হয়। ফ্যামিলিতে যদি কেউ
দেখে যে বাবা মায়েরা এসব করছেন, তাহলেই না
করতে শিখবে! আমি আঁতকে উঠেছিলাম। আমিও
তো পরিবারে অনেক কিছুই দেখেছি। কিন্তু আমি
কোনও সামাজিকতা রক্ষায় ভুল করলেই কি বংশের
দোষ উঠে আসবে??
তখন আমি শুরু করেছিলাম disposable জিনিসে
মানুষের বাসায় খাবার দেয়া। বাটি ফেরত দেয়ার
দায়বদ্ধতা নেই! যখন মনে চাইবে, তখন কিছু দিলে
সে ভিন্ন কথা। আর হ্যাঁ, লজ্জা লাগলেও, আমিও খালি
বাটিই ফেরত দেই। লজ্জাটা তো আসে অভ্যাস
থেকে। আসলে তো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই!
আমার যখন মনে চাইবে, আমিও নিশ্চয়ই দিবো!
৩ । উপহার দেয়ার মাঝে স্ট্যাটাস
মেয়ের মায়ের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী
মেয়ের বিয়েতে আসবেন না। অথচ তিনি
আজীবন মেয়েটিকে ভালবেসেছেন নিজের
মেয়ের মত করেই। তাঁদের দুই বান্ধবীর দুই
মেয়ে সমবয়সী এবং ফ্রেন্ড! বান্ধবীকে
প্রশ্ন করাতে তিনি বুঝিয়ে বললেন, “আমি কী
দিবো তোর মেয়েকে? আমি জানি তুই কিছুই
মনে করবি না, তবু এত মানুষ আসবে, আমি কিছুই দিত
পারবো না, কিভাবে যাই?” তাঁকে বার বার আশ্বস্ত করা
হল যে বিয়েতে গিফট আনতে নিষেধ করা
হয়েছে। তিনি সেই বিয়েতে যান এবং
পরবর্তীতে বলেন যে জীবনে প্রথম একটি
বিয়েতে তিনি নিশ্চিন্ত মনে গিয়েছেন, তাঁর ভাবতে
হয়নি যে কী নিতে হবে!
আরেকটি বিয়েবাড়ি। বিয়ের পরের দিন সকাল বেলা
বর উঠে দেখেন ড্রয়িং রুমে কিসের যেন লিস্ট
পড়ে আছে! দেখে তিনি রাগে তা কুটি কুটি করে
ছিঁড়লেন! কী ছিল ওতে? কে বিয়েতে কী
গিফট দিয়েছে তার লিস্ট! কেন? কারণ যে যা
দিয়েছেন, তার সমমূল্যের জিনিস তাঁদের
ছেলেমেয়েদের বিয়েতেও দিতে হবে যে!
সাধ্য থাকুক, সাধ্য না থাকুক, দিতেই হবে! আর এই
চক্র চলতেই থাকবে!
একবার একজন আমাকে রুপার একজোড়া কানের দুল
গিফট করেছিলেন। খুব সুন্দর দুল। আমি ঠিক
করেছিলাম সেটা আমার একজন খুব কাছের
বান্ধবীর বিয়েতে গিফট করবো। কেবল যে
সে খুব কাছের তা না, তার বরও বহু বছরের পরিচিত!
একজন আমাকে বললেন, “একজনের বিয়েতে
সামান্য একজোড়া রুপার দুল উপহার দিবে, স্ট্যাটাস
নাই?” তিনি বয়সে বড় হলেও সেদিন আমি উত্তর
দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি যা, সেটাই
আমার স্ট্যাটাস। তাছাড়া, ধার করে সোনার দুল উপহার
দেয়ার মাঝে আমি তো কোনও স্ট্যাটাস দেখছি
না!
বলতে থাকলে, এমন টুক টাক অনেক কিছু বলা
যাবে, যা আমরা প্রতিনিয়তই করি, অন্যের ওপর তার
কী প্রভাব পড়ে তা না ভেবেই! ধরুন কারুর সামর্থ্য
আছে যে ২০০০ টাকার মিষ্টি নিয়ে যাবে কারুর বাসায়
দাওয়াত খেতে। যার বাসায় যাচ্ছেন, তার জন্য হয়ত
৫০০ টাকার মিষ্টি কোথাও নেয়াটা সাধ্যের অতিরিক্ত!
যিনি নিলেন ২০০০ টাকার মিষ্টি, তার উদ্দেশ্য কাউকে
ছোট করা না, নিজের লেভেল অনুযায়ী
presentable কিছু নেয়া। কিন্তু যার জন্য নিলেন,
তাঁকে যদি দাওয়াত করেন ভবিষ্যতে, তিনি হয়ত
“যোগ্য” কিছু হাতে করে নিতে হবে সেই
দুশ্চিন্তাতেই দাওয়াতে যাবেন না! সবাই চায় ভালো
কিছু নিতে, নিজের সম্মান বজায় রাখতে। কিন্তু সম্মান
যখন সাধ্যের বাইরে মূল্যবান হয়ে ওঠে, তখন
কী করবে?
খেয়াল করে দেখলেই দেখা যাবে, এভাবে
অনেক কাছের মানুষই দূরে চলে যায়! অন্যের
কথা বাদ দেই, “নিতেই হবে” ব্যাপারটা কি আমাদের
নিজেদের কখনোই বোঝা মনে হয় না? আজকাল
তো ৫০০ টাকার কমে মিষ্টিই নেয়া যায় না কোথাও!
খুব ভালোবেসে নিলে ভিন্ন কথা, কিন্তু নিতেই
হবে ভেবে নিলে চাপ কি পড়ে না? একটা ছেলে
যখন বিয়ে করে, স্বাভাবিক ভাবেই জীবনের
শুরুতে হাতে একগাদা টাকা থাকে না। তখন প্রতি
দাওয়াতে তাকে দই মিষ্টি নিতে হবে— এটা যে তার
ওপর কত বড় বোঝা–সেকথা কি কারুর মনে
আসে? বরং কোথাও স্ট্যান্ডার্ড মত কিছু না নিলে
আড়ালে কত কথা হবে!
হ্যাঁ, হয়ত বলবেন ভালোবেসে কেউ কারুর জন্য
কিছু নিলে কী সমস্যা? নাহ, কোনও সমস্যা নেই।
কেবল ভালবাসার সংজ্ঞাটা যে কিছু নিবে, তার ওপর
ছেড়ে দেয়াই কি ভালো না? সেটা কি করা হয়?
সমাজ ঠিক করে কার বাড়িতে কী নেয়াটা স্ট্যান্ডার্ড!
সমাজ! ফলে, একসময় “তোমার সমাজে তুমি
থাকো, আমার সমাজে আমি” — এই বিভক্তিটা তৈরি হয়!
যাদের সামর্থ্য আছে, তারা কিন্তু এই নিয়মটা ভাংতে
পারে খুব সহজে! কারণ, দুনিয়ার হিসাবে তারাই
সমাজের মাথা!
আজকে সামর্থ্য থাকার পরও যদি কেউ খালি হাতে
দাওয়াতে যান, তো সেটা হয়ে থাকবে এক অসাধারণ
উদাহরণ! সমালোচনা করবে লোকে। করুক। কিন্তু
কালকে তাঁর দাওয়াতে স্বল্প আয়ের একটি পরিবার
যেতে পারবে মাথা উঁচু করে!! আজকে সুস্থ
থেকেও যদি আমি মানুষের বাটি খালিই ফেরত দেই,
কালকে আরেকজন অসুস্থ ভাবী আমাকে বলতে
পারবেন, ভাই আমি তোমার বাটিটা খালিই পাঠালাম, আমার
শরীরটা ভালো নেই! আজকে সামর্থ্য থাকার পরও
যদি আমরা বিয়ে বাড়িতে খালি হাতে যাই, কাল আমাদের
ছেলে মেয়েদের বিয়েতে একজন হয়ত হাল্কা
মন নিয়ে আসবেন!
আবারও, আমি বলছি না আমরা উপহারের আদান প্রদান
বন্ধ করে দিবো! মনে চাইলেও কারুর জন্য কিছু
করবো না! একশো বার করবো! কিন্তু,
কোনকিছুকে বাঁধা ধরা নিয়ম বানিয়ে করবো না! প্রথা
বানিয়ে ফেলবো না! আমাদের কাজ যেন
অন্যের জীবনটা জটিল করে না দেয়, সেদিকে
একটু খেয়াল রাখবো! নিয়ম না বানিয়েও ভালবাসার
আদান প্রদান সম্ভব! আমরা সেটার জন্য চেষ্টা
করতে পারি!
হয়ত কথাগুলো খুব ছোট মানসিকতা তুলে ধরল। জানি
না। কিন্তু আমি দেখেছি মানুষকে নিয়ম রক্ষা করতে
যেয়ে কষ্ট করতে, কষ্ট পেতে। দেখেছি
কিভাবে আত্মীয় আত্মিয়ের কাছ থেকে দূরে
সরে যায় ভালবাসার মূল্য পরিশোধ করার সামর্থ্য না
থাকার কারণে! তাই মনে হয়েছে, দিন বদলের সময়
এসেছে! জীবনটা সুন্দর! নিজের জন্যে হোক
বা অন্যের জন্য, অযথা সবকিছু কঠিন করে দেয়ার
তো কোনও প্রয়োজন নেই! নিয়ম-প্রথা
এসবের চেয়ে ভালবাসার মানুষগুলো যে অনেক,
অনেক দামী! অনেক দামী সেই
সম্পর্কগুলো! ইনশাআল্লাহ আমরা সম্পর্ক সুন্দর
রাখতে মানুষের জন্য করবো– শুষ্ক নিয়ম বজায়
রাখতে না!! আর না!
লিখেছেন – নায়লা নুযহাত

এসো আলোর পথে

About আলোর কাফেলার সঙ্গী

আমি একজন মুবাল্লিগ ... আল্লাহ আমাকে কবুল করুন. আমিন

Posted on ডিসেম্বর 7, 2015, in ইসলামী সমাজ গঠন, প্রেম-ভালবাসা love-affair, যৌবন কাল, রেহনুমা বিনত আনিস and tagged . Bookmark the permalink. এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান